font-help

এই পোস্টটি 2,218 বার দেখা হয়েছে

আদিবাসী মেলা প্রসঙ্গে কিছু কথা।

শুভ্র জ্যোতি চাকমা

আদিবাসী মেলা প্রসঙ্গে কিছু কথা

 

আমাদের এই নদীমাতৃক বাংলাদেশ এমনই একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত দেশ যেখানে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অনেক সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের জনজাতি বাস করে। বাংলাভাষীদের বাদ দিয়ে বসাবাসকারী অন্যান্য জাতিদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে আরো বর্ণাঢ্যময় করে তুলেছে। মোট কথা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই দেশ-বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদ তাদের এক সংকলনে এদেশে ৪৫টি নৃ-তাত্ত্বিক জনজাতির নাম প্রকাশ করেছিল। বলা হয় যে, এ সংখ্যা আরো বেশি। সংখ্যা যা-ই হোক না কেন তারা এদেশেরই নাগরিক এবং সংবিধান অনুসারে সমান সুযোগ লাভের অধিকারী। সম্প্রতি পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক আদেশে আদিবাসী শব্দটির পরিবর্তে উপজাতি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হচেছ-পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুসারে উপজাতি শব্দটি আইনগত স্বীকৃত, আদিবাসী শব্দটি নয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে ওহফরমবহড়ঁং ফধু ঘোষণা করার পর থেকে আদিবাসী শব্দটি নিয়ে এদেশে বিতর্ক চলছে। এ ওহফরমবহড়ঁং ফধু -এর বাংলা অনুবাদ করা হয় আদিবাসী দিবস। আদিবাসী শব্দটি তৎকালীন বিএনপি সরকার অফিসিয়ালি গ্রহণ তো করেইনি উল্টো বলেছে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই, যারা আছে তারা হচ্ছে উপজাতি। অন্যদিকে, নৃ-তাত্ত্বিক জাতিদের মধ্যেও অনেকে আদিবাসী শব্দটি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়, উপজাতি শব্দটিও তাদের কাছে অপমানজনক। অদ্যাবধি এটি সুরাহা হয়নি। ফলে অনেকে আদিবাসী, পাহাড়ি, ুদ্র জাতি, অনেকে উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করছে। মোট কথা, বিশেষণের কোন শেষ নেই। তবে আমি মনে করি, কোন বিশেষণ চাপিয়ে না দিয়ে যে যার পরিচয় যেভাবে দিতে চায় বা করতে আগ্রহী তাদেরকেই সে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। যেমন-আমাদের তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যেই অনেকেই তাদের জাতীয় পরিচিতির বানান লিখে থাকেন তনচংগ্যা। পরিচয়ের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। আলোচ্য প্রবন্ধে পরিচয় বিতর্কে না গিয়ে নৃ-জাতি হিসেবেই তুলে ধরা হল। এবার প্রবন্ধের মূল উপজীব্যে ফিরে আসা যাক।

 

 

গত ১২ ফেব্র“য়ারী কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও চ্যানেল আই-এর উদ্যোগে আয়োজিত ২য় আদিবাসী মেলা। এ জাতীয় মেলা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঝঊঐউ(ঝড়পরবঃু ভড়ৎ ঊহারৎড়হসবহঃ ্ ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ) এবং টঘউচ-ঈঐঞউঋ আয়োজন করে থাকে। গত ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে টঘউচ-ঈঐঞউঋ আয়োজিত মেলাটির নাম ছিল ওহফরমবহড়ঁং ঈঁষঃঁৎধষ ঋবংঃরাধষ. মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ১০০টির বেশি স্টলে নৃ-জাতিদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। এ বছর আয়োজিত মেলায় ফ্যাশন শো-তে নৃ-জাতিদের বেশি পরিমানে খাট পোশাকে উপস্থাপন করায় গন্ডগোল সৃষ্টি হয়। বোঝাই যাচ্ছে অপসংস্কৃতি রোধে নৃ-জাতিরা খুবই সচেতন। কক্সবাজারে আয়োজিত মেলাটি আয়োজক হিসেবে চ্যানেল আই প্রায় পুরো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করায় দেশ বিদেশের হাজার হাজার দর্শক এটি দেখার সুযোগ পেয়েছে। গত বৎসরের তুলনায় এ বৎসর মেলার পরিধি বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। যোগ করা হয়েছে নতুন কিছু অনুষ্ঠান। তবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিদের চোখ ধাঁধানো সাংস্কৃতিক পর্ব মেলার মূল উপাদান বলতে হবে। মেলায় নৃ-জাতিদের কিছু স্টল বাদে বেশিরভাগ স্টলই হচ্ছে চ্যানেল আই-এর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রসারে যেসকল প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করেছে তাদের। যারা ঐ সময়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন অনুষ্ঠানটি তাদের জন্য বাড়তি পাওয়া ছিল। ইতোপূর্বে যারা টেলিভিশনের পর্দায় নৃ-জাতিদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন তারা একেবারে কাছ থেকে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ লাভ করেছিলেন। তবে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে মেলার আয়োজন করার ব্যাপারটি কেমন যেন মনে হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন সৃষ্টি করে যে, নৃ-জাতিদের বর্ণাঢ্যময় সাংস্কৃতিক উপাদানকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না তো ? উদ্বোধনী কিংবা মেলায় নৃ-জাতিদের মধ্য থেকে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বা করা হলেও তাদেরকে অনুষ্ঠান মঞ্চে ডাকা হয়নি। গত বছরও তা-ই করা হয়েছিল। এতে নৃ-জাতিদের অসম্মান দেখানোর সামিল হয়েছে বলে মনে হয়। মেলার নাম দিয়ে শুধুমাত্র উলেখযোগ্য কিছু নৃত্য পরিবেশন করা হয়। নৃ-জাতিদের বর্ণাঢ্যময় সংস্কৃতিকে শুধু পণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে না তো ? আয়োজকরা এর সঠিক জবাব অবশ্যই দেবেন বলে আমরা আশা করতে পারি। এছাড়া মেলার নামকরণ নিয়ে তো প্রশ্ন থেকেই যায়। বলা হচ্ছে আদিবাসী মেলা। প্রকৃতপে এটির নাম হতে পারত আদিবাসী সংস্কৃতি মেলা। আদিবাসী বলতে নৃ-জাতিদেরকেই তো বোঝানো হয়। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে অনেকটা এরকম-আদিবাসী মানুষদের মেলা বা হাট। সাধারণত কোন মেলা বা হাটে যে নামের মেলা বসে সে ধরনেরই জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। যেমন-কোরবানীর পশুর হাটে কোরবানীযোগ্য পশুই পাওয়া যায়, শাড়ির মেলায় শাড়িই পাওয়া যায়। তাহলে আদিবাসী মেলা বলতে কি বোঝানো হচ্ছে না, ঐ মেলায় আদিবাসী মানুষ কিনতে পাওয়া যাবে বা বিকিকিনি হবে ? গভীরভাবে ভাবতে গেলে অনুষ্ঠানের নামকরণটি একেবারেই অসম্মানজনক। আয়োজকরা নামের স্বপে যত যুক্তি দেখান না কেন সাধারন দৃষ্টিকোণ থেকে এটিই মনে হয়। আয়োজকরা হয়তো এটাই বলবেন-আদিবাসী সংস্কৃতিকে প্রসারের জন্য এই উদ্যোগ। কিন্তু অনুষ্ঠানে কোন নৃ-জাতি বা আদিবাসীকে মতামত বা বক্তব্য প্রদানের জন্য না ডাকা বা অতিথিদের মধ্যে প্যালেনভূক্ত না করার ব্যাপারটি নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করে। নেতৃস্থানীয় কাউকে না ডেকে কতিপয় নৃত্য শিল্পীকে মঞ্চে নাচিয়ে একটি মেলা হয় কিভাবে ? যেখানে নৃ-জাতিদের মতামত প্রদান করার কোন সুযোগই দেয়া হয় না বা দেবার প্রয়োজনবোধও মনে করা হয়নি। নৃ-জাতিদের হাতের পুতুলের মত ব্যবহার করা কোন অবস্থাতেই সমীচীন নয়। আয়োজকদের নৃ-জাতিদের সংস্কৃতির প্রতি যদি এতই দরদ থাকে তাহলে সেটি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন অঞ্চলে আয়োজন করা যেত না ? ব্যাপারটি কী তাহলে যাত্রা পালায় নৃত্য আয়োজন করে মানুষ জড়ো করার মত হচ্ছে না ? নৃ-জাতিদের ভালবাসতে হয় তো হৃদয় থেকে ভালবাসতে হবে। তাদেরকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে মুনাফা আদায়ের সংস্কৃতি থেকে বিরত থাকতে হবে। এ বিষয়টি সরকারের উর্দ্ধতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষনের দাবী রাখে।

 

নৃ-জাতিদের সংস্কৃতির বিকাশে অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া জাতীয় সংস্কৃতি নীতি ২০০৬-এ নৃ-জাতিদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের বিষয়টি স্পষ্ট করে উলেখ করা হয়েছিল। আমরা স্বীকার করি সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এজন্য সরকার বেসরকারি সংস্থাকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করে থাকে। বর্তমান সময়ে শি ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া নৃ-জাতিদের একার পে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে প্রসার ও উন্নয়ন করা একার পে সম্ভব নয়। এমনকি তাদের স্বকীয় সংস্কৃতিকে লালন ও ধরে রাখাও কষ্টসাধ্য বলে মনে হয়। ফলে, তারা স্বকীয়তা হারিয়ে পর সংস্কৃতি নির্ভর হয়ে পড়ছে। যা কারোর কাম্য নয়। এজন্য তাদের সংস্কৃতির বিকাশ, উন্নয়ন এবং প্রসারে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ সুবিধা দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে উন্নিত করতে হবে। তা না হলে আমরা অনেক রীতি-নীতি, প্রথা, বিশ্বাসসহ নান্দনিক সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবো। তবে আন্তরিকতার পিছনে যাতে মুনাফা লাভের তাৎপর্য নিহীত না থাকে। নৃ-জাতিরা যদি তাদের স্বকীয়তা হারায় তাহলে দেশও হারাবে তার বর্ণাঢ্যতা। যে বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির জন্য আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করি। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও চ্যানেল আই-এর যে উদ্যোগ তা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশেষত অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে চ্যানেল আই কতৃপ যে মহত্বতা দেখিয়েছে তার কোন তুলনা চলে না। কিন্তু এ উদ্যোগে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে-এ কথা স্বীকার করতে হবে। আশা রাখতে পারি আগামীর উদ্যোগগুলিতে যেন আমরা উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে দায়সারা ভাব দেখতে না পাই। এতে করে নৃ-জাতিদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতিকেই সম্মান প্রদর্শন করা হবে। নৃ-জাতিদের সংস্কৃতি অত থাকার মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা বহমান থাকুক-এ প্রত্যাশা রেখে পিছিয়ে পরা নৃ-জাতিদের সংস্কৃতির উন্নয়ন ও প্রসারে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

 

বিদ্রঃ- এই লেখাটি ২০১০ ইং সালে বনযোগীছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত স্ববন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

এই বিভাগের আরো পোস্ট

Tags: 

আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*