font-help

এই পোস্টটি 2,671 বার দেখা হয়েছে

মানবাধিকার ও আদিবাসী নারী প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রফেসর মংসানু চৌধুরী

প্রফেসর মংসানু চৌধুরী

মানবাধিকার ও আদিবাসী নারী  প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম

১. ঔপনিবেশিক শাসন এবং জাতি রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরা নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এগুলো শতাব্দী প্রাচীন এবং ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ শাসনাধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সামগ্রিক জীবন ধারাকে পরিচালিত করেছিল। একেবারেই জীবন-নির্বাহী জীবিকা, আদি-সহজ-সরল সমাজ কাঠামোকে কেন্দ্র করেই এগুলো বিন্যস্ত হয়েছিল। বিবর্তনের ধারায় যেভাবে সমাজ-জটিলতা বাড়ে–সেই অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সমাজে জটিলতা হানা দিয়েছে এমনটা কিন্তু বলা যাবে না। সদ্য গজিয়ে উঠা ক্ষুদ্র ‘আরবান’ সমাজকে বাদ দিলে ‘আরবান’ সমাজের প্রান্তসীমার বাইরের বিশাল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজে সামাজিক অপরাধকর্ম কিন্তু এখনও অনুল্লেখযোগ্য।

ঔপনিবেশিক শাসনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের যে ঐতিহ্যবাহী সমাজ ও রাজনৈতিক কাঠামো এবং বিদ্যমান সময় ও জীবিকার প্রয়োজনে যে সমস্ত প্রথাগত আইন সৃষ্টি হয়েছিল, তার পাশাপাশি বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ইংল্যান্ডের রাজকীয় কোষাগারকে স্ফীত করার মানসে এই পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল থেকে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যে বেশ কিছু বিধানও প্রচলন করেছিল যেগুলোতে আদিবাসীদের অনেক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অধ্যায়ে এই সমস্ত বিধি-বিধানকে সরকারী নীতির উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে আরও পোক্ত করা হয়েছে নানাভাবে। ফলে ইতিমধ্যে সংকুচিত আদিবাসী অধিকার আরও ক্ষীণ কলেবর হয়েছে। কিন্তু যে একটি বিষয় আমাদের সকলের অগোচরে ধীরে ধীরে বঞ্চনার প্রাকার তৈরী করেছে তাহলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের অধিকারকে আরও খন্ডিত করা। আজকের এই নিবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের অধিকার-বঞ্চনা ও প্রান্তিকরণের গাঁথা খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজ জুম চাষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে শতবর্ষ ধরে। এখনও জুম চাষ এখানকার আদিবাসী অর্থনীতির একটি শক্ত খুঁটি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে শত প্রতিকূলতা উপো করে। আদিবাসী গৃহস্থ পরিবারের জীবিকার একটি বড় অবলম্বন হিসেবে এখনও জুমের অবস্থানের শক্ত ভিত নড়ে যায়নি কৃষি-জগতে নানান অগ্রগতির পরেও। জুম চাষের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বনজসম্পদও আদিবাসীদের জীবিকার একটি বড় উৎস। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, এই আরণ্য জনপদে শতাব্দীকাল ধরে আদিবাসী জনগোষ্ঠী পাহাড়ের বুকে ফসল বুনেছে শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। সেখানে মুনাফার কোন প্রত্যাশা ছিল না, ছিল না কোন বিলাসিতার মোহ । জীবিকার এই জীবন-নির্বাহী ব্যবস্থাতেই তারা তৃপ্ত ছিল ।

আদিবাসী জীবিকার এই চালচিত্রে আদিবাসী নারীর ভূমিকা দ্বৈত–উৎপাদন এবং সংজনন কিংবা প্রজনন। ফসল বোনা ও সন্তানের জন্ম দেয়া। এই দুই ভূমিকায় আদিবাসী নারী খেটে চলে উদয়ান্ত। এখানে একদিকে সে প্রেমময়ী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মা অন্যদিকে একজন সক্রিয় উপার্জনকারী। তাকে সন্তানের জন্ম দিতে হয়, লালন পালন করতে হয়। ঘর-গেরস্থালীর যাবতীয় কাজ ছাড়াও স্বামীর সাথে জুমের কাজে, বন থেকে বনজদ্রব্য আহরণে শ্রম দিতে হয়, বেচাকেনার জন্য বাজার পর্যন্ত চলে আসতে হয়। বিকিকিনির জন্য বাজারে গিয়ে চতুর ব্যাপারীদের খপ্পরে পড়ে, ভাষা ভালো না বুঝতে পেরে এই সহজ-সরল আদিবাসী গৃহবধূটি দামে প্রতারিত হয়। দিনের পর দিন অপরিসীম শ্রম দিয়ে উৎপাদিত ফসল কিংবা আহরিত বনজ সামগ্রী যে অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করে তারা বাজারে নিয়ে আসে তার ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হয়ে চলে। এভাবে উপার্জিত অর্থে তেল, নুন ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী কিনতে গিয়ে আবারও তাকে প্রতারিত হতে হয় বাজারের দোকানীর কাছে। প্রতারনা, বঞ্চনা এইসব খেটে খাওয়া আদিবাসী নারীদের নিত্য সঙ্গী।  আবার কাজের ফাঁকে সামান্য অবসর যদি মেলে তখন কাপড় বুনতে বসে যায়। দেহের একটুখানি সুখ, যত্ন, রূপ পরিচর্যার কথা তাকে ভুলে যেতে হয়। এ সব তো তার জন্য বিলাসিতা। ঘুর্ণারেও কখনো কি তার মনে এই চিন্তার উদয় হয়েছে যে, তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? তার মানবাধিকার লংঘন হয়েছে? ভাবা যায়, এই আদিবাসী নারী যদি কখনো জুয়াড়ী, মাতাল স্বামীর হাতে পড়ে তাহলে কি হবে? তখন তাকে তার স্বামীর ঐ সব বদভ্যাসের খরচ যোগাতে হবে, তার মন্দ ব্যবহার, বদ আচরণ, অহেতুক নির্যাতন সইতে হবে।

৩. বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির যে দর্শন তাতে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়নি। রাষ্ট্রের সংবিধানে তাই আদিবাসীদের কোন স্বীকৃতি নেই। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের ধারায় মূলধারার জনগোষ্ঠীর ক্রমসম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের মুখে অসহায় এই জনগোষ্ঠীর লোকালয়, তাদের জীবিকার উৎস বন-পাহাড়-জমি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে তাদের জীবন ধারণ প্রক্রিয়াকে সংকটাপূর্ণ করে তুলেছে। তাদের জীবিকার উৎস এত দ্রুত সংকুচিত হয়ে গেছে যে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মত কোন উপায় তারা দাঁড় করাতে পারেনি কারণ উৎপাদনে সম কোন সম্পদ বা দতা তাদের জানা নেই। ভয়াবহ দারিদ্র্য আজ তাদের জীবনের বাস্তবতা। আদিবাসীদের জীবিকার ভিত্তি, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যে যে একটা অমোচনীয় বন্ধন ছিল তা ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে চলেছে। আর এই নাজুক অবস্থার অনিবার্য বলি হলো আদিবাসী নারী ।

৪. আদিবাসী সমাজে নারীরা স্বকীয় বর্ণ বৈচিত্র্যমন্ডীত অলংকারে, পোষাকে-আচ্ছাদনে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের মূর্ত্ত প্রতীক। আবহমান ঐতিহ্যের ধারায় আদিবাসী নারী নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। অনুরূপভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীরাও নিজেদের নৃ-পরিচয় ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এমন পরিধেয় ও ব্যবহার্য বিভিন্ন পদের কাপড় নিজস্ব তাঁতে তৈরী করে। এ সব বেশ-ভূষা দর্শণে ঐ নারী কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তা সহজে চেনা যায়। বিভিন্ন উৎসব পার্বণাদিতে মদের ব্যবহার আদিবাসী সমাজের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যও বটে। এই মদ তৈরী থেকে শুরু করে মদ্য পানের রীতি-পদ্ধতি, মদ্য পানে ব্যবহৃত বিভিন্ন পাত্রসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন সরঞ্জামাদি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। মদ তৈরীর বিভিন্ন কৌশল -পদ্ধতি আদিবাসী নারীরাই আবহমানকাল ধরে ধরে রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে রন্ধন শৈলী, পীঠা-পুলি তৈরীর ধারাও ভিন্ন ভিন্ন। কোন কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রন্ধন-কলা রীতিমত বিস্ময়কর। আদিবাসী নারী যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিা নেই, প্রশিণ নেই, প্রচলিত কোন মশলার ব্যবহার নেই–শুধুমাত্র জুমে গজিয়ে উঠা কিছু পাতা-গুল্ম সহযোগে রান্না এত উপদেয় হতে পারে তা চেখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এগুলো আদিবাসী রমনীর একান্ত সিক্রেট ও সম্পদ। আর সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ও কার্যকর বাহন ভাষা–সন্তান সন্তুতির মাধ্যমে মায়ের এই মুখের ভাষাকে সঞ্চারিত করে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহের মূখের ভাষা এখনও যেটুকু পর্যন্ত টিকে আছে তা এই মাতৃময়ী নারীদের কারণে।

এই অঞ্চলের প্রায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব নৃত্যকলা, গান রয়েছে। নাচে-গানে ছেলে ও মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ থাকে । কিন্তু এসব কাজে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি স্বতঃস্ফুর্ত এবং কারণে অকারণে, কাজের ফাঁকে নাচ-গানের চর্চা মেয়েদের মধ্যেই বেশি। ফলে আদিবাসী সংস্কৃতির এই দিকটাও মূলতঃ আদিবাসী মেয়েরাই ধরে রেখেছে।

কিন্তু মানুষ কখন আনন্দ উৎসব করে, নাচে, গায়, সামাজিকভাবে ভোজন পর্বের আয়োজন হয়, পানোৎসব চলে!  যখন তার জীবিকার উপর কোন হুমকি তৈরী না হয়, যখন তার জীবিকার্জনের যে উপায় তাতে ছেদ না পরে, জীবিকার যে উৎস মূখ তা বন্ধ না হয়ে যায় । কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের চিরায়ত জীবনের ছন্দপতন ঘটেছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে- —যার ধারাবাহিকতা আরও বড় কলেবরে প্রসারিত হয়ে যথাক্রমে পাকিস্তান  আমল পেরিয়ে বাংলাদেশের সময়কাল অবধি সম্প্রসারিত হয়েছে। চুক্তিপূর্ব দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত ছিল। এতে করে এখানকার আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়াসহ তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। ফলে এঞ্চলের আদিবাসী নারী তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী সমূহ মতার বলয়ের বাইরে থেকে যাওয়ায় সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের অবস্থানও দুর্বল ; নারীর অবস্থান তো আরও নাজুক । ফলে বিভিন্ন বিরূপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আদিবাসী নারীকে কায়িক ও বাচনিকভাবে অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখোমূখি দাঁড়াতে হয়। নিজস্ব পরিমন্ডলের বাইরে অনেক সময় আদিবাসী নারীকে তার চেহারা,বেশ-ভূষার কারণে অহেতুক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় । এগুলো একজন নারী হিসেবে, আদিবাসী নারী হিসেবে তার স্বীকৃত অধিকারের লংঘন।

৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানা প্রথা বৃটিশদের মস্তিস্কজাত। তার আগে জুম চাষ করে পার্বত্য আদিবাসীদের জীবিকা নির্বাহ হতো । জুম চাষ প্রথায় যেহেতু প্রতি বছর জুমতে পরিবর্তন করতে হয় (একটি জুম ক্ষেত একবার চাষ করলে তা কয়েক বছর ফেলে রাখতে হয় মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা পুনরুদ্ধারের জন্য) তাই স্বাভাবিক কারণেই পাহাড়ে জমির মালিকানা ধারণার প্রয়োজনীয়তা কখনই অনুভূত হয়নি। এখানে মাটি, জমি, পাহাড়,জঙ্গল, জলাশয় সবই ছিল সমাজের, জনগণের। কিন্তু নিষ্ঠুরতায়, দস্যূপনায় সিদ্ধহস্ত লোভী ও আগ্রাসী বৃটিশ বেনিয়াদের জহুরী চোখে এই জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্যাঞ্চলের সম্পদ-মূল্য ঠিকই ধরা পড়লো। অধিক রাজস্ব আদায়ের তাড়নায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, বনভূমিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত করতে দেরী করেনি। অচিরেই কমিউনিটির সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে ন্যস্ত হল। নিষিদ্ধ হল সংরতি বনাঞ্চলে আদিবাসীদের প্রবেশ, বিচরণ ও বনজদ্রব্য আহরণ। বৃটিশ বেনিয়াদের কাছে মানুষের জীবিকা ও প্রাণের চাইতে রজতমুদ্রার মূল্য ছিল অনেক বেশি । তারা হিসেব কষলো । জুম চাষিকে ধরা যায় না কারণ সে জায়গা বদলায় । অতএব তাদের পাকড়াও করে নামিয়ে নিয়ে আস সমতলে। জঙ্গল সাফ করে দু’একখন্ড জমির মালিকানা ধরিয়ে দাও তাদের হাতে । আদিবাসী সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, তাই জমির মালিক করা হলো পুরুষকে। মহাশক্তিধর ইংরেজ প্রভূ যখন পুরুষকে সম্পত্তির মালিক করতে মনস্ত করেছে, অতএব সেই নিয়মই সই । তাই পিতার মৃত্যু হলে মালিকানাও গিয়ে বর্তাল তার ছেলে সন্তানের হাতে। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের সূচনা । নারীকে বঞ্চিত করে সেই যে উত্তরাধিকার প্রথার যাত্রা শুরু হলো তা অদ্যাবধি অপরিবর্তিত অবস্থায় এই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজে চালু আছে।

সারাজীবন নিজেকে উজার করে দিয়ে পরিবারের সুখে-দুঃখে, জীবিকা সংগ্রহের কাজে যে আদিবাসী নারী উদয়াস্ত খেটে চলে তার বিনিময়ে সে কি পেল? পিতার সংসারে না পিতৃ সম্পত্তির অংশের অধিকার, না স্বামীর সংসারে স্বামীর সম্পত্তির অংশের অধিকার। পিতৃ সংসারে থাকলে নারীর বিয়ে না হওয়া অবধি কেবলমাত্র ভরণপোষণের অধিকার ছাড়া আর অন্য কোন সম্পদে তার কোন অধিকার নেই।  আবার মায়ের সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কয়টা মা এরূপ সম্পদ ধারণ করতে পারে, সে প্রশ্নও থেকে যায়। সুতরাং পিতার কিংবা স্বামীর অবর্তমানে সন্তানরাও যদি যে যার মত আলাদা হয়ে যায় তখন সেই নারীর কি অবস্থা হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? এ প্রশ্নের কে উত্তর দেবে?

কোন কোন আদিবাসী সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর অনধিকারের পে যুক্তি দেখানো হয় যে, পিতৃ/স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার বর্তালে সেই সম্পত্তি আদিবাসী সমাজের বাইরে চলে যেতে পারে বা যাবে যদি সেই নারী কোন অ-আদিবাসীর জন্য বিয়ে বসে। এই যুক্তি খুবই ঠুন্কো কারণ সম্পত্তি যাতে অ-আদিবাসীর কাছে হস্তান্তরিত না হয় তার জন্য তো বিধান করা যেতে পারে। এ ধরণের খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নারীকে পিতৃ/স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করাটা অন্যায় ও অমানবিক। এটি পুরুষতান্ত্রিকতার এক ধরণের স্বেচ্ছাচার।

সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর অবস্থানকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে অনেকখানি নাজুক করে রেখেছে। আবার সমাজে পুরুষ প্রাধান্যের অনিবার্য ফলশ্র“তিতে পুরুষের উপর নারীর নির্ভরতাকে বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার প্রথা আরও প্রকট করে তুলেছে। নারীর মুক্তিকে করেছে প্রলম্বিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু মারমা জনগোষ্ঠী ছাড়া প্রায় সকল আদিবাসী সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথা বৈষম্যমূলক ।

ব্যমান এই ইস্যুর চুড়ান্ত নিষ্পত্তির ল্েয শুধুমাত্র আদিবাসী নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি সাফল্য বয়ে  নিয়ে আসবেনা । পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যেও সচেতনতার সঞ্চারণ ঘটাতে হবে। এই লক্ষ্যে উভয়ের উদ্যোগে যৌথ কর্মশালা, সেমিনার হতে পারে। সুখের কথা, ইতিমধ্যেই কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে। ল্যনীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের একটি প্লাটফর্মের অধীনে নিয়ে আসার জন্য কোন পুরুষ প্রাধান্যপূর্ণ সংগঠনের জন্য বসে না থেকে এ অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের তাদের অভিষ্ট্য ল্েয পৌঁছার জন্য একটা নিজস্ব উদ্যোগ থাকা খুবই জরুরী।

৬.পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারী পৃথিবীর আরও অনেক আদিবাসী সমাজের অনুরূপ নিগ্রহ ও বৈষম্যের শিকার হয় সাধারণত দু’ভাবেঃ

ক. আন্তঃ সামাজিক বৈষম্যঃ

প্রথমত:, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারী পুরুষের অধীনে থাকে। এখানের নারীর ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ তার ভূত-ভবিষ্যত, লেখাপড়া, বিবাহ, স্বাস্থ্য র, সন্তান ধারণ সবকিছুরই নিয়ন্তা পুরুষ। আহার প্রস্তুত, ভোজন ক্রিয়া ও পর্ব সম্পাদনের জন্য যা যা করনীয় আছে সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ অনুপস্থিত। যন্ত্রের মত নারী সেখানে খেটে চলেছে সেই কাক ডাকা ভোর থেকে নিশুতি রাত পর্যন্ত বিরামহীন, বিশ্রামহীন। নারী এখানে শুধু আজ্ঞাবহ। কেনা বাঁদী বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী-পুরুষের মধ্যে এই বিভাজন রেখা টেনে রেখেছে। আমরা কোন বিবেকবোধ ও যুক্তির প্রয়োগ ছাড়াই এই বিভাজন রেখাকে মেনে নিয়েছি। মানুষ হিসেবে নারীর অধিকারকে পদদলিত করে তার বঞ্চনার পরিধিকে বৃদ্ধি করে চলেছি। মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার যদি পদদলিত হয় তবে পুরুষও মানুষের দাবিতে সমাজে যে সমস্ত অধিকার ভোগ করে চলেছে সেই অধিকার সে দাবি করতে পারে কি? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। পুরুষের কাছে এ প্রশ্নের কী উত্তর আছে?

খ. বর্হি-সামাজিক বৈষম্যঃ

প্রথমত, এই বৈষম্য মূলতঃ আধিপত্যবিস্তারী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী থেকে উৎসারিত । দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলন চলেছিল। ১৯৯৭ সনে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে এই অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক ইতি টানা হলেও পরিস্থিতির তেমন কোন গুনগত পরিবর্তন হয়েছে এমনটা বোধ করি দাবি করা যাবে না বিরাজমান বাস্তবতার বিচারে। কথিত সংঘাতে হাজার হাজার প্রাণের বলি চড়ানো হয়েছে জিঘাংসার কৃপাণে। চরম মূল্য দিতে হয়েছে আদিবাসী নারীকে। পাশবিক লালসার শিকার হয়েছে অসংখ্য আদিবাসী রমনী, অপহৃত হয়েছে অনেকেই। জবরদস্তি পানিপীড়ন করা হয়েছে এমন আদিবাসী নারীর সংখ্যাও মোটেই ফেলনা নয়। আদিবাসী নারীর নাজুকতা একাধিকঃ প্রথমত:, সে নারী। পুরুষ যতন পর্যন্ত একজন নারীকে শুধু তার সামাজিক পরিচয়ে নারী রূপেই দেখবে, মানবিক পরিচয়ে মানুষ হিসেবে গণ্য করবেনা ততন পর্যন্ত ঐ পুরুষের কাছে নারী নিরাপদ নয়। এরপর দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হ’লো –সে কোন পরে নারী। উত্তর যদি হয় প্রতিপরে, তাহলে সে নারী আরও বেশি অনিরাপদ প্রতিপ ঐ পুরুষের কাছে।

দ্বিতীয়ত, সে নারী কিন্তু আদিবাসী। অধিকার ও বঞ্চনার বিচারে তার অবস্থান প্রান্তিকে। অতএব দুর্বল, নিপীড়নের সবচেয়ে অসহায় শিকার। তদুপরি শারীরিক গঠনে, পোষাকে-আশাকে, আকারে-বিচারে ভিন-জাতির পুরুষের কাছে তার অন্যরকম আবেদন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মূলঃধারার জনগোষ্ঠীর প্রায় ০.৭৫% । এই নগণ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রন করতে যখন অস্ত্রের ব্যবহারের সিদ্ধান্তে যেতে হয় তখন সেখানে সামন্ত মানসিকতার প্রাধান্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক  সামন্ত মানসিকতার কাছে মানবাধিকার, মানবিকতার মূল্য, আদিবাসী রমনী সম্ভ্রম হারানোর বেদনার মূল্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ ।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তার ঝুঁকিকে জিইয়ে রেখেছে। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পূনর্বাসিত সমতলবাসীদের দ্বারা আদিবাসী নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে। আদিবাসী নারীর মানবিক অধিকার রার পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি কোনটাই তেমন দানা বাঁধতে পারছেনা। ধর্ষণের শিকার আদিবাসী নারী শুধু শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়নি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়েছে। অপমান ও অবমাননার দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবন তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে যা ভাষায় অপ্রকাশ্য।

৭.  অন্যান্য অনেক সমাজের মত শৈশবাবস্থাতেই আদিবাসী মেয়েদের কাজের ধারা নির্ধারিত হয়ে যায়। মায়েদের অনুরূপ তাদেরকে গৃহস্থালী কাজে অভ্যস্ত করানো হয় যাতে বয়:প্রাপ্তিতে সংসার জীবনে প্রবেশের সাথে সাথেই ঘরকন্নার আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পাদন করতে পারে । এই ভূমিকায় আদিবাসী মেয়েকে ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি সময় সংসারের নানান প্রয়োজন মেটাতে ব্যয় করতে হয়। ফলে লিঙ্গভিত্তিক এই কর্ম-বিভাজনের কারণে অন্যান্য অনেক সমাজের অনুরূপ অনেক আদিবাসী মেয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিা গ্রহণের সুযোগ হয়ে উঠে না।  বোঝার বয়স হওয়ার সাথে সাথেই প্রতিটি মেয়ের ভাবনায় এই চিন্তাটাই অনবরত ঢোকানোর চেষ্টা করা হয় যে, তাকে বিয়ে করে সন্তাান ধারণ, সন্তান লালন করতে হবে। এটিই নারীর ধর্ম। অন্যসব কাজকর্ম, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ সবই গৌণ ।

কিন্তু বিপরীতে একটি ছেলেকে প্রতিষ্ঠানিক শির জন্য তৈরী করা হয়, উৎসাহ দেয়া হয়, কারণ সে রোজগেরে হবে। আর মেয়ে সন্তানকে হেঁসেলে ঢুকতে হবে, সবার জন্য আহার্য্য-পানীয় তৈরী করতে হবে এবং তার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই তাকে করতে হবে। এ সমস্ত কারণে বিদ্যালয়ে মেয়েদের ঝড়ে পড়ার হার, অশিতি থেকে যাওয়ার হার অনেক বেশি ।

শিয় মেয়েদের অধিগমনের সুযোগ কম কারণ তার মূল ভূমিকা পরিবারের সবার জন্য সব ধরনের সেবার আয়োজন করা। ঘরের চার দেয়ালই তার পৃথিবী। তদুপরি দূর দূরান্তে মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়টিও মেয়েকে উচ্চ শি প্রদানে অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করে। সামাজিক যে দর্শনটি নারী শির উৎসাহে রাশ টেনে ধরে তা হলো মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে অর্থাৎ পরের ঘরে চলে যাবে কিন্তু ছেলে বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসবে, আয়-রোজগার করবে। অতএব তাকে শিখতে হবে, বিদ্যা অর্জন করতে হবে যা নারীর প্রয়োজন নেই। এছাড়াও বিদ্যালয়ের দূরত্ব, দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা, ভাষিক প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদিও নারী শিকে অনেকখানি বাধাগ্রস্ত করে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা আদিবাসী নারীর মানবিক অধিকারকে অনেখানি ুন্ন করেছে।

৮. স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি প্রতিটি মানুষের অধিকার। কিন্তু নারী হওয়ার সুবাদে আরও কতিপয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যা কেবল মাত্র নারীদের জন্য প্রযোজ্য। যেমন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। এটি নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে এমনিতেই নারীর অবস্থান প্রান্তিক । আদিবাসীদের অবস্থান আরও প্রান্তিক। আর তাই তার অবস্থান বড় বেশি নাজুক ও ভঙ্গুর। সাধারণ বিচারে আদিবাসী নারী হিসেবে সমাজ ও  রাষ্ট্রীয় জীবনে তার যে নির্ধারিত অবস্থান সেই অবস্থান সমাজে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে আর দশটি মূল ধারার নারীর অবস্থান থেকে অনেক নীচে। কিংবা সুযোগ সুবিধা একেবারেই অনুপস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে, এমনকি  উপজেলা পর্যায়েও এটি একটি চলমান বাস্তবতা। স্বাস্থ্য কর্তৃপরে উদাসীনতা, ব্যবস্থাপনার অদতা কিংবা স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতার কারণে আদিবাসী নারীর স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির অধিকার সংকুচিত হয়েছে। অধিকার ুন্ন করা একটি সাংবিধানিক অপরাধ। স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের মধ্যে রক্তশূণ্যতার ব্যপকতা, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, শিশু মৃত্যুর হার রীতিমত অস্বাভাবিক। উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকির পাশাপাশি রোগ-বালাই, অসুখ-বিসুখ বৃদ্ধির প্রবণতা কিন্তু অনেক বেশি দৃশ্যমান। পরিবারে, সমাজে উপেতি, শি ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত আদিবাসী নারী এই সব রোগ ব্যধির সহজ শিকার।

৯. পরিবেশের অবনয়নে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয় আদিবাসী নারী। কারণ আদিবাসী নারীরা প্রধানত: জীবন-নিবার্হী উপৎপাদনকারী অর্থাৎ দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে যা যা প্রয়োজন শুধু তা-ই উৎপাদন কিংবা সংগ্রহ করা এবং এজন্য তারা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর খুব বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী রমনীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। আশৈশব চারপাশে পাহাড় আর বনের আদিগন্ত বিস্তৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠে আদিবাসী জীবন। বেঁচে থাকার জন্য অন্য সব উপকরণের মধ্যে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হয় সর্বাগ্রে। আর আশেপাশের পাহাড় ও বন এই চাহিদার সিংহ ভাগ পূরন করে। অরণ্যের বুক চিরে এই খাদ্য সম্ভার সংগ্রহের কাজ ঐতিহ্যগতভাবে আদিবাসী নারীরাই করে থাকে। অরণ্য নির্ভর সমাজে কর্ম-বিভাজনের যে ঐতিহ্য তাতে শক্তিয়ী কাজ যা মূলত: শারীরিক শক্তি নির্ভর সেগুলো পুরুষেরা সম্পাদন করে কিন্তু অপোকৃত হালকা শ্রমের কাজ যেখানে অনবরত লেগে থাকার প্রশ্ন জড়িত, ধৈর্য্যরে প্রয়োজন হয় সে কাজগুলো নারীর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে। যুগ পরিক্রমায় সামাজিক এই প্রথা আরও সংহত হয়েছে। কর্ম-বিভাজনের এই রীতি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের গৃহাস্থলীর প্রয়োজনীয় কাজ রান্না-বান্না, পানি ও জ্বালানি সংগ্রহ করা ছাড়াও প্রায়শই ফসলের েেতর মাটি আলগা করা, আগাছা নিড়ানো, চারা রোপন, ফসল কাটা, ফসল তোলা ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থাকতে দেখা যায়। বিশ্বের উষ্ণায়ন, কিছু সংখ্যক অর্থগৃন্ধু মানুষের উদগ্র লালসার শিকার হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উষ্ণমন্ডলীয় বিশাল বনভূমি আজ বিরান প্রান্তরের রূপ ধারণ করেছে। এই অরণ্য নিধন পুরুষ অপো আদিবাসী নারীকে আঘাত করেছে বেশি। রান্না-বান্না, পানি ও জ্বালানি সংগ্রহে তার কষ্টের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে কারণ এগুলোর প্রাপ্তিস্থল আরও দূরে সরে গেছে। পরিবেশের বিপর্যয়ে আদিবাসী নারীর বঞ্চনা আরও বেড়েছে ।

প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী নারীর রয়েছে অমূল্য ভূমিকা। কারণ আদিবাসী জীবনের অস্তিত্ব এবং চলমানতা একান্তই প্রকৃতি প্রদত্ত সম্ভারের প্রাপ্যতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । খাদ্য, জ্বালানি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য প্রতিটি আদিবাসীকে তার লোকালয় সংলগ্ন বন ও পাহাড়ের উপর নির্ভর করতে হয়। আর এসব উপকরণের অধিকাংশই নারীরাই সংগ্রহ করে নিয়ে আসে বেশি। আদিবাসী নারী জানে যে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হলে, বন উজার হলে তাকেই সংকটে পড়তে হবে। তাই এই সম্পদ রার জ্ঞান তার নিজেরই স্বার্থে তাকে আয়ত্ত্বে আনতে হয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, বনে গেলে আদিবাসী নারী কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কিছুই আহরণ করে না ।

অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক মৌজাতেই হেডম্যান/কার্বারীর নেতৃত্বে পাড়াবাসীদের অংশ গ্রহণে তাদের গৃহস্থালীর প্রয়োজন মেটানোর ল্েয ’ভিলেজ কমন ফরেস্ট’ নামে বিশাল এলাকা জুড়ে প্রাকৃতিক বন সৃষ্টি করা হতো। এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন কোন মৌজায় এধরণের বনের অস্তিত্ব ল্য করা যায়। এধরণের বন থাকায় পাড়াবাসীরা যেমন তাদের প্রয়োজনীয় আহার্য্য , জ্বালানী ইত্যাদির নিশ্চয়তা পেত তেমনি তাদের পানির উৎসও রতি হতো। এই বন সৃষ্টিতে পুরুষদের চাইতেও নারীদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। অথচ প্রাকৃতিক এই সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নারীর ব্যাপক ভূমিকা থাকার পরও মৌজার অন্তর্গত ‘ভিলেজ কমন ফরেস্ট’ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নারীদের কোন অংশগ্রহণ নেই। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়েছে।  এখানেও আদিবাসী নারীকে তার প্রাপ্য ভূমিকা পালন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

১০. পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃত্বের কাঠামোতে ( ঐতিহ্যবাহী, নির্বাচিত স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংস্থা) আদিবাসী নারীর প্রতিনিধিত্বের কোন জোরালো উপস্থিতি দেখা যায় না। কী নির্বাচিত, কী ঐতিহ্যবাহী কোন সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী নারীর কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই  যদিও পার্বত্য রাজনীতিতে সক্রিয় আদিবাসী ব্যক্তিবর্গ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামে আদিবাসী নারীর অবদানের কথা অকুন্ঠ চিত্তে স্মরণ করেন কিন্তু তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতিফলন তাঁরা কার্যেেত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার প্রমাণ নির্বাচিত স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংস্থায় নারীদের জন্য সীমিত আসন ব্যবস্থা । আসন যেমন সীমিত তার সাথে সংগতি রেখে নারীদের ভূূমিকাও অনুল্লেখযোগ্য। ২২ সদস্য সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও ৩৪ সদস্য সম্বলিত প্রতিটি পার্বত্য জেলা পরিষদে নারী প্রতিনিধিত্বকে মাত্র ৩ জন নারী সদস্যের মধ্যে, যেখানে ২ জন আদিবাসী নারী, সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন জেলা পরিষদগুলোতে ৫ জন সদস্যের মধ্যে এ যাবৎ পর্যন্ত কোন নারী সদস্যকেই অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। কেবলমাত্র বান্দরবান জেলার অন্তবর্তী পরিষদে ২০০১-২০০৬ মেয়দে পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন নারী আর বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার অন্তবর্তী পরিষদের মনোনীত ৫ সদস্যের একজন নারী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রতিষ্ঠানেও (রাজা, হেডম্যান, কার্বারী ) দুইএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া নারী প্রতিনিধিত্ব অনুপস্থিত। কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী নারীদের সম্পৃক্ত হতে সাধারণত দেখা যায় না । এমনকি নারীদের জন্য নির্দিষ্ট ও আচরনীয় চিরায়ত পারিবারিক অনুশাসন থেকে কোন নারী নিজেকে অবমুক্ত রাখতে পারলেও স্থানীয় মতা কাঠামোতে তাদের অন্তর্ভূক্তির ব্যাপারে পুরুষ প্রাধান্যপূর্ণ সমাজে সাধারণত অনীহা ল্য করা যায়।  আদিবাসী অর্থনীতির চাকাকে যে নারী নিজের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে দিয়ে, রাত-দিনের পরিশ্রমে সচল রেখেছে সমাজের সার্বিক কল্যাণে তার মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়া হবে না — সমাজের এ বিধান রীতিমত অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য।

১১.  এতসব আলোচনা ও বিশ্লেষণ শেষে বোধ করি শুধু একটি কথা খুব শক্ত করে বলা যায় যে, সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নারী — তাদের অধিকার বঞ্চিত রেখে বৃহত্তর অঙ্গনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের গাল ভরা বুলি শুধু বাগাড়ম্বর সর্বস্ব হয়ে আমাদের গ্লানিকে ভারি করে তুলবে। সাফল্যের সিংহদ্বার অবধি আমাদের কখনই পৌঁছানো হবে না। আদিবাসী নারী কিন্তু সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির প্রয়োজনে তার পুরুষ সাথীর সহযাত্রী হয়েছে বহুযুগে বহুবার । কিন্তু তারপরেও স্বভিমানী পুরুষের কাছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয় নি। অবলা ভেবে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার ক্ষেত্র  তার সবলা হওয়ার সব সুযোগকে অবারিত করতে চায় নি। স্বার্থপরের  মতো নিজেদের আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ করতেই বরঞ্চ সচেষ্ট থেকেছে সব সময়। জগতের বর্ণাঢ্য ইতিহাসে আমরা বহু অবিসংবাদিত মুক্তিসংগ্রামী নেতাদের দেখা পাই যাদের সাফল্যের গাঁথার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে তাদের সহধর্মিণী অনেক মহিয়সী নারীর অপরিসীম ত্যাগ, সীমাহীন তিতি আর নিরবচ্ছিন্ন অনুপ্রেরণা। তবে আশার কথা হল এই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী সম্প্রদায়ের একটি অংশে, যদিও ক্ষুদ্র, তাদের অধিকার বিষয়ক ভাবনা ক্রমশঃ সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে। ছোট ছোট আলোচনা সভা, কর্মশালায় তাদের সরব উপস্থিতি আমাকে রীতিমতো আন্দোলিত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী সমাজের মানসভূবনে বঞ্চনা থেকে মুক্তির চেতনার এই উন্মেষ ক্রমে বানভাসি স্রোতের মতো প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে বৃহত্তর পরিসরে পার্বত্য আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের পথকে আরও প্রশস্ততর করবে, উৎসাহে গতি সঞ্চারিত হবে, সংগ্রামকে আরও বেগবান করে তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর পুরুষরা এখানে অনুঘটক হয়ে কাজ করুক-এই আমার প্রার্থনা

১২.       পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর মতায়নের জন্য কতিপয় সুপারিশমালাঃ

(ক)       স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

(খ)        নারী শিকে সর্বোচ্চ আগ্রাধিকার ও সর্বাতœক উৎসাহ দেয়া জরুরী।

(গ)        গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণ

নিশ্চিত করা বাঞ্চনীয়।

(ঘ)        নারীর আত্ন-কর্মসংস্থানমূলক/আয়বর্ধনমূলক সুযোগের সম্প্রসারণ।

(ঙ)        ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার সংস্থা ও জাতীয় সংসদে নারীর

ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার।

এই বিভাগের আরো পোস্ট

Tags: 

আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*