পাহাড়ের সম্পদ-সম্ভাবনা। ড. সেলু বাসিত
আমার একটি লেখা ছিল “জুমিয়াদের সুরা ঃ জাতীয় প্রবৃদ্ধির সূচক পাহাড়ের সম্পদ সম্ভাবনা” তাতে বলেছিলাম এবং প্রায়শই যে কথাটির উপর জোর দেই তা হলো ঃ বাংলা ও বাঙ্গালী অন্তর্গত ুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের নিজস্ব পরিচয় বাংলা-বাংলাদেশের ঐক্য সংহতি, জাতীয় অগ্রগতি, জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণ, ভাষিক বাস্তবতা, আভ্যন্তরিন অভিভাসন প্রক্রিয়ার সাথে যেমন বিবেচ্য তেমনি প্রোপটে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে ভারতবর্ষের আসাম-ত্রিপুরা-মিজোরাম-বিহার-ঝাড়খন্ড কিংবা বার্মা/মিয়ানমারের ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করে তাদের সাংস্কৃতিক, আর্থিক, চাষাবাস বাস্তবতার অনুসন্ধান। তাহলে জীবন-যাপন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনার ত্রেজ উপলব্ধি নিরুপনে সহায়ক হবে বলেই-ুদ্র জাতিগোষ্ঠির, বিভিন্ন সম্প্রদায় উপজাতীয় জনসমাজের যাপিত জীবনকে বিঘিœত না করে, সামাজিকরণ প্রক্রিয়া সচল রাখতে হবে, জাতি-রাষ্ট্রের সমাজ-সংগঠনের অন্তর্গত প্রবাহের সাথে দূরান্বয় সৃষ্টি না করে তাদের সাংস্কৃতিক-ভাষিক-অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য ও কর্মকান্ডকে সুরা দিতে হবে। জাতি-রাষ্ট্রের ঐতিহ্যিক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের অংশীদার রূপেই বিবেচনা করতে হবে তাদের। এতে তাদের নিজেদের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সমৃদ্ধ হবে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকে তাদের নিম্নতম অংশগ্রহণও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে জাতীয় অর্থনৈতিক ধারায় একথা নিসন্দেহে যথার্থ।
পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলার ভূ-সম্পদ, কৃষি সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ উৎপাদন শক্তি এবং পর্যটন শিল্পের বিকশিত অবস্থান জাতীয় সম্পদের সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করবে যদি ওই অঞ্চলের মানব সম্পদকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এবং সাংবিধানিক সুরা প্রদান করা যায়।
খধহফ ড়ভ চৎড়সরংব হিসেবে পার্বত্য অঞ্চল জাতীয় সম্পদের এক অপরিপেয় প্রান্তর। ঈযরঃঃধহমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং উরংঃৎরপঃ এধুধঃঃবৎ, ১৯৭৫ সূত্রে এই অঞ্চলের সর্বমোট ব্যবহৃত ভূমির পরিমাণ ছিল ৩২,৫৯,৫২০ একর কিন্তু কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার একর জমি ডুবে গিয়ে জলাধারের সর্বোচ্চ উচ্চতার বিপরীতে ২১,৫২২ একর ভূমি পাওয়া যায়। তম্মধ্যে কাচালং সংরতি বনাঞ্চলের ৪০ বর্গমাইল এলাকা আবাদ করে ১০,০০০ একর জমি মাত্র ৩,৭৩৪টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয় পুনর্বাসনের জন্য আবাদ করা ছাড়াও সংরতি নিম্নাঞ্চলের ৩০ বর্গমাইল এলাকা কাপ্তাই হ্রদে নিমজ্জিত হয়, নিমজ্জিত অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ২৩৪ বর্গমাইল। মানব সৃষ্ট পরিবেশগত ভূপরিবর্তনের কারণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়ে পরিবেশ উদ্ধাস্তু মানুষের ইতিহাস। ব্যবহৃত ভূমির মধ্যে ছিল বন আচ্ছাদিত ভূমি, কৃষি-অনুপযোগী ভূমি, পতিত কৃষি-উপযোগী ভূমি, কৃষিভুক্ত ফসলী ভূমি, পতিত ভূমি, নীচু জাতীয় ফসলী ভূমি, চাষভুক্ত ভূমি।
সাম্প্রতিক নানা তথ্য উৎস্য থেকে জানা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১৩,১৮১ বর্গ কি. মি. এলাকায় কৃষি-ভূমি বর্তমানে ০৫ শতাংশ এবং অকৃষি ভূমি ৯৫ শতাংশ। তাতে ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম রহঃবহংরঃু অর্থাৎ কৃষি প্রগাঢ় বৃদ্ধি করে ফলন/উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক ভূমি ব্যবহার জরিপ পূর্ণাঙ্গভাবে মূল্যায়ন করলে প্রাকৃতিক অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও চাষ পদ্ধতি অর্থাৎ জুম চাষকে গণ্য করতে হবে, সে-েেত্র বনাবৃত ও পাহাড়ি ভূমি, মিশ্র বন বিভাগের আওতাধীন ভূমি সমন্বয়ে ভূমি-ব্যবস্থা উৎপাদন-বান্ধবরূপে কার্যকর করতে হবে। আর তা কার্যকর করতে গেলে জুমিয়াদের প্রাকৃতিক জ্ঞান উৎসের বিবর্তন ক্রিয়ার যে কৃষি ব্যবস্থাপনা তা আত্ম-জীবন চর্চার খাদ্য আহরণ প্রক্রিয়ায় মানুষের স্যভরী দৃষ্টিভঙ্গীতে এক সৃজনী কৌশল ছিল জীবন-সংগ্রামের অব্যাহত সংগ্রামে, আর তা আজও বৈষয়িক-সামাজিক ব্যবস্থায় লোক-আর্থ চেতনায় গ্রথিত। তাই জুমিয়াদের কৃষি ও আর্থ ব্যবস্থাপনাকে কিংবা ইঁৎহ অমৎরপঁষঃঁৎব কে নিঃসন্দেহে কৃষি উৎপাদনের ভুক্তশ্রেণী হিসেবে বিবেচনা করে উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে, কারণ পার্বত্য অঞ্চলের অধিকতর ভূমি ব্যবহার বাস্তবতা এর উপরই নির্ভরশীল।
॥ দুই ॥
পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চল আর বসতি অঞ্চলের পাশাপাশি ঝোপ-ঝাড় ছিল ভেষজের উদ্ভিদের এক উৎসত্রে সেসব জায়গায় অনায়াসে পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ যা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় বললেই চলে। এমনকি প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অন্যান্য উদ্ভিদের সঙ্গে ঔষধি উদ্ভিদগুলোর উদগম ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। অথচ কয়েক দশক পূর্বেই বাংলাদেশ থেকে ঔষধি উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত উপকরণ রপ্তানী করা হতো। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাবে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা পাহাড়ের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ উদ্ভিদ ও ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল হিসেবে ইন্দো-চায়না ও আরাকান অঞ্চলের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ধরে নেয়া হয়। পার্বত্য জেলার কেবল উত্তর বন বিভাগের মাইনি, সাজেক ও কাছালং রিজার্ভ এবং দণি বন বিভাগের কাপ্তাই, কর্ণফুলী, সীতাপাহাড়, রামপাহাড়, থেগা ও রাইংখিয়ং রিজার্ভে ভালো চিরসবুজ বন বিদ্যমান। এখানে উলেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি ভেষজ উদ্ভিদের তালিকা সম্বলিত পুস্তক প্রকাশ করেছে তাতে ১০০ টি ভেষজ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যায়। তম্মধ্য বিরল প্রজাতির বেশ কিছু ঔষধী উদ্ভিদ রয়েছে যেমন-মেনজিয়াম, মিনজিরি, মালকানা, তেলসুর, বৈলাম, চাম্পা, ধারমারা, গুটগুইট্যা, গোদা, তুন, বকাইন, বান্দরহোলা, কাইনজল, কুড়চি, তেজবল, চিকরাশি, পিটালি, মেন্দা, চাপালিশ, গামার ইত্যাদি। ভেষজ উদ্ভিদের রাসায়নিক ও প্রায়োগিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উপকরণ সৃষ্ঠির ব্যবস্থাপনা জাতীয় চাহিদা পূরণ করে আন্তর্জাতিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথকে সুগম করতে পারে। একপ মতে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭.০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ভেষজ উদ্ভিদজাত ঔষধ বিক্রি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে এর বিক্রয় পরিমাণ দাঁড়াবে ৫.০০ ট্রিলিয়ন ডলার। পার্বত্য অঞ্চল ভেষজ উদ্ভিজ থেকে এক সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটন করতে পারে।
॥ তিন ॥
পার্বত্য জেলা সমূহের ুদ্র জাতি-গোষ্ঠী প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক এবং গার্হস্থ্য বৈশিষ্ট্য। সাংস্কৃতিক এবং গার্হস্থ্য উপাদান সে বৈশিষ্ট্যকে নিদর্শন রূপে উপস্থাপিত করে স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যবহারিক মূল্যমান। ব্যবহারিক মূল্যমান আজকের সাংস্কৃতিক-আর্থমূল্যের হারে বিবেচনা করলে এ সম্পদ
আন্তর্জাতিক অর্থমূল্যের ধারণায় অনেক অনেক গুরুত্ব বহণ করে। এেেত্র যেমন নৃত্যগীত, বাদ্যযন্ত্র, আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত সামগ্রী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ব্যবহৃত অলংকার, তাঁত বস্ত্রাদী, পোষাক পরিচ্ছেদ ইত্যাদি যা বস্তুগত এবং অবস্তুগত মানস সম্পদের এক সমৃদ্ধ জগৎ। এই সম্পদের এক জরীপ কার্যক্রম যদি পরিচালনা করা হয় তাহলে এই সম্পদের মূল্যমান নির্ধারণ যেমন সম্ভব হবে তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পার্বত্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক এবং গার্হস্থ্য সম্পদের মূল্যমানকে তুলে ধরা সম্ভব হবে।
॥ চার ॥
সর্বোপরি পাহাড়ের বড় সম্পদ হলো মানব-সম্পদ, এই সম্পদকে মর্যাদা দিয়ে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, ক্রীড়া ত্রে, শিা, কৃষি এবং বাণিজ্যের নানা সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে যদি নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এথেকে সুফল পাওয়া সম্ভব। পর্যটন আর পরিবেশ সচেতনতা, মানবাধিকার ও মানব উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার েেত্রও পাহাড়ের মানব সম্পদ উজ্জ্বলতা দেখাতে পারে।
তাই আনন্দময় জীবনের সূত্রে জাগ্রত পাহাড়ের জীবনকে, জীবন সংগ্রামের কৌম উৎসজাত বস্তু অন্বেষণ আর সম্পদ সম্ভাবনার কর্মকান্ডকে অব্যাহত ধারায় করতে হবে ক্রীয়াশীল ও সজীব।